৮৫-৮৬ নং আয়াতের তাফসীর: হযরত ইসমাঈল (আঃ) ছিলেন হযরত ইবরাহীম খলীলের (আঃ) পুত্র। সূরায়ে মারইয়ামে তাঁর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। হযরত ইদরীসের (আঃ) বর্ণনা গত হয়েছে। যুল কিফলকে বাহ্যতঃ নবীরূপেই জানা যাচ্ছে। কেন না, নবীদের বর্ণনায় তার নাম এসেছে। কিন্তু লোকেরা বলেছেন যে, তিনি নবী ছিলেন না, বরং একজন সৎ লোক ছিলেন। তিনি তাঁর যুগের বাদশাহ ও ন্যায় বিচারক। ইমাম ইবনু জারীর (রাঃ) এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করেন। নাই। সুতরাং এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।মুজাহিদ (রাঃ) বলেন যে, তিনি একজন সৎ ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তার যুগের নবীদের চুক্তি ও অঙ্গীকার করেছিলেন এবং ওর উপর প্রতিষ্ঠি ত ছিলেন। কওমের মধ্যে তিনি ন্যায় বিচার করতেন। বর্ণিত আছে যে, যখন হযরত ইয়াসাআ' (আঃ) খুবই বৃদ্ধ হয়ে যান তখন তিনি নিজের জীবদ্দশাতেই তার একজন প্রতিনিধি নির্বাচন করার ইচ্ছা করেন। তিনি তার আমল দেখতে চান। সূতরাং তিনি জনগণকে একত্রিত করেন এবং বলেনঃ “তিনটি প্রস্তাব যে ব্যক্তি সমর্থণ করবে তাকে আমি খিলাফত বা প্রতিনিধিত্ব প্রদান করবো। প্রস্তাব তিনটি এই যে, সে সারাদিন রোযা রাখবে, সারা রাত দাড়িয়ে ইবাদত করবে এবং কখনো রাগান্বিত হবে না।' তার একথা শুনে একটি লোক ছাড়া আর কেউই পঁড়ালো না। যে লোকটি দাঁড়ালো তাঁকে মানুষ হাল্কা মর্যাদার লোক মনে করতো। তিনি দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেনঃ “অর্থাৎ তুমি দিনে রোযা রাখবে, রাত্রে তাহাদের নামায পড়বে এবং কারো উপর রাগ করবে নাঃ" লোকটি উত্তর করলেনঃ “হ” হযরত ইয়াসা'আ বললেনঃ “আচ্ছা, আজকে তোমরা চলে যাও, কালকে আবার একত্রিত। হও।” পরদিনও তিনি মজলিসে সাধারণভাবে প্রশ্ন করলেন। কিন্তু ঐ লোকটি ছাড়া আর কেউই দাঁড়ালো না। সুতরাং তিনি তাকেই খলীফা বা প্রতিনিধি নির্বাচন করলেন। এখন শয়তান ছোট ছোট শয়তানদেরকে এই সম্রান্ত ব্যক্তিকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে পাঠাতে শুরু করলো। কিন্তু তারা তাকে কোন ক্রমেই বিভ্রান্ত করতে পারলো না। তখন ইবলীস নিজেই চললো। ঐ বুযুর্গ লোকটি দুপুরে বিশ্রামের জন্যে সবে মাত্র শুয়েছেন এমন সময় ইবলীস শয়তান তার দরজার কড়া নাড়তে শুরু করে। লোকটি জিজ্ঞেস করলেনঃ “তুমি কে?” ইবলীস বলতে শুরু করলোঃ “আমি একজন অত্যাচারিত ব্যক্তি। আমার কওমের একটি লোক আমার উপর জুলুম করেছে। সে আমার সাথে এটা করেছে, ওটা করেছে। এভাবে সে দীর্ঘ বর্ণনা দিতে থাকে। সে তার বর্ণনা শেষ করতেই চায় না। তাঁর ঘুমাবার সময়টুকু তার সাথেই কেটে যায়। হযরত যুলকিফল (অর্থাৎ ঐ সম্রান্ত লোকটি) দিন রাত্রির মধ্যে শুধু এই সময়টুকুতে সামান্য কিছুক্ষণের জন্য ঘুমাতেন। তিনি তাকে বললেনঃ “তুমি সন্ধ্যায় এসো, তোমার প্রতি ন্যায় বিচার করা হবে। অতঃপর সন্ধ্যায় তিনি বিচার করতে বসলেন তখন চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করে ইবলীসকে খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু কোন দিকেই তাকে দেখা গেল না। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেই বাইরে গিয়ে তাকে এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু কোথায়ও তাকে পেলেন না। পর দিন সকালেও সে এলো না। আবার যেমনই তিনি দুপুরে সামান্য বিশ্রামের জন্যে শুয়েছেন তখনই সে দরজায় করাঘাত করতে শুরু করেছে। তিনি দরজা খুলে দেন এবং তাকে বলেনঃ “আমি তো তোমাকে সন্ধ্যায় ডেকে ছিলাম এবং তোমার জন্য অপেক্ষমান ছিলাম, তখন তুমি আস নাই কেন?" সে উত্তরে বলেঃ “ জনাব! কি আর বলবো? আমি আপনার কাছে আসার ইচ্ছা করেছি এমন সময় আমার হক নষ্টকারী লোকটি আমাকে অনুরোধ করে বলেঃ “তুমি যেয়ো না, আমি তোমার প্রাপ্য তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি।”কাজেই আমি এলাম না। কিন্তু এখন আবার সে অস্বীকার করেছে।” এভাবে আজকেও বহু লম্বা চওড়া বর্ণনা শুরু করে দেয়। সুতরাং আজও তার ঘুম নষ্ট হয়ে যায়। এবারও তিনি তাকে সন্ধ্যায় আসতে বলেন। সন্ধ্যায় আবার তিনি তার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু সে আসলো না তৃতীয় দিন তিনি একজন দ্বাররক্ষী নিযুক্ত করে তাকে বলে দিলেনঃ “দেখো, আজ যেন কেউই আমার দরজায় করাঘাত না করে। উপুর্যপরি কয়েকদিন কাহিল হয়ে পড়েছি। একথা বলে তিনি সবে মাত্র শুয়েছেন এমন সময় আবার ঐ বিতাড়িত শয়তান এসে পড়ে। দ্বাররক্ষী তাকে বাধা দেয়। কিন্তু সে এক তাকের মধ্য দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে এবং ভিতর থেকে দরজায় করাঘাত করতে শুরু করে দেয়। তিনি তখন উঠে দ্বার রক্ষীকে বলেনঃ “আমি তোমাকে বলে দেয়ার পরেও কেন তুমি একে দরজায় আসতে দিলে?" দ্বার রক্ষী উত্তরে বললোঃ কেউ তো যায় নাই?” এবার তিনি ভালরূপে দেখে শুনে। বুঝতে পারলেন যে, দরজা তো বন্ধই রয়েছে, আবার ভিতরে লোক প্রবেশ করলো কিরূপে? কাজেই এটা শয়তান ছাড়া কেউই নয়। ঐ সময় শয়তান তাকে সম্বোধন করে বললোঃ “হে আল্লাহর ওয়ালী! আমি আপনার নিকট পরাজিত হয়েছি। না আপনি রাত্রির ইবাদত পরিত্যাগ করেছেন, না এরূপ পরিস্থিতিতে আপনার দ্বার রক্ষী ভৃত্যের উপর রাগান্বিত হয়েছেন।” তখন আল্লাহ তাআলা তার নাম রাখলেন যুলকিফল। কেননা, যে বিষয়ের তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন তা বাস্তবে দেখিয়ে দিয়েছেন। (এটা ইবনু আবি হাতিম (রাঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতেও কিছু তাফসীরের পর এই ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে। তাতে রয়েছে যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে একজন কাযী (বিচারক) ছিলেন। যিনি তাঁর মৃত্যুর সময় বলেছিলেনঃ “আমার পরে আমার এ পদের দায়িত্ব কে গ্রহণ করবে?” উত্তরে এই লোকটি (যুলকি) বলেছিলেনঃ “আমি গ্রহণ করবো।” তখন তার নাম যুলকিফল হয়ে যায়। এতে আছে যে, তাঁর ঘুমাবার সময় হলে প্রহরীরা শয়তানকে আসতে বাধা দেয় সে এতো গোলমান শুরু করে দেয় যে, তিনি জেগে ওঠেন। দ্বিতীয় দিন ও তৃতীয় দিনও এরূপই করে। তখন তিনি তার সাথে যেতে উদ্যত হয়ে বলেনঃ “আমি তোমার সাথে গিয়ে তোমার হক আদায় করে দিচ্ছি।” কিন্তু রাস্তায় গিয়ে সে তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়।হযরত আশআরী (রাঃ) মিম্বরের উপর ভাষণ দেয়া অবস্থায় বলেনঃ “যুকিফুল নবী ছিলেন না। তিনি ছিলেন বানী ইসরাঈলের মধ্যে একজন সৎ লোক, যিনি প্রত্যহ একশ (রাকাত নামায পড়তেন। তিনি এই ইবাদতের দায়িত্ব পালন করেছিলেন বলে তাঁকে যুলকিফল বলা হয়েছে। একটি মুনকাতা (যে হাদীসের সনদের মধ্য হতে মাঝে মাঝে রাবী বা বর্ণনাকারী ছুটে গেছেন। ঐ হাদীসকে মুনকাতা হাদীস বলে) হাদীসে হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ) হতেও এটা বর্ণিত আছে। মুসনাদে আহমাদে একটি গারীব বা দুর্বল হাদীস বর্ণিত আছে। যাতে কিল এর একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তাকে যুলকিফুল বলা হয়। নাই। সম্ভবতঃ তিনি এই ফুলকিফুল নন। বরং অন্য কোন লোক হবেন। হাদীসের ঘটনাটি এই যে, কিক্ল নামক একজন লোক ছিল, যে কোন পাপকার্য হতেই বিরত থাকতো না। একদা সে একটি স্ত্রীলোককে ষাটটি দীনার (স্বর্ণমুদ্রা) দিয়ে ব্যভিচারের জন্যে উৎসাহিত করে। যখন সে নিজের কামনা চরিতার্থ করার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যায় তখন ঐ স্ত্রীলোকটি ক্রন্দন করতে ও কাপতে শুরু করে দেয়। সে তখন তাকে বলেঃ “আমি তোমার প্রতি কোন বল প্রয়োগ তো করি নাই তথাপি তোমার ক্রন্দনের ও কম্পনের কারণ কি? স্ত্রীলোকটি উত্তরে বলেঃ "আজ পর্যন্ত আমি আল্লাহ তাআলার কোন নাফরমানী করি নাই। কিন্তু আজ আমার অভাব ও দারিদ্র আমাকে এ কুকাজে বাধ্য করছে। (তাই, আমি আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করছি ও কম্পিত হচ্ছি)!" তার একথা শুনে কি তাকে বলেঃ “তুমি মাত্র একটি পাপ কার্যের কারণে এতো উদ্বেগ প্রকাশ করছো! অথচ এর পূর্বে তো তুমি এরূপ কোন কাজ কর নাই। তৎক্ষণাৎ সে তাকে ছেড়ে দেয় এবং তার থেকে পৃথক হয়ে যায়। অতঃপর তাকে বলেঃ “যাও, এই দীনারগুলি আমি তোমাকে দান করে দিলাম। আল্লাহর শপথ! আজ হতে আর কোন দিন আমি আল্লাহ তাআলার কোন নাফরমানী করবে না। আল্লাহর কি মহিমা যে, ঐ রাত্রেই তার মৃত্যু হয়ে যায়। মানুষ সকালে এসে দেখে যে, তার দরজার উপর কুদরতী হরূফে লিখিত রয়েছেঃ “আল্লাহ কিকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।”